Kashmir Diary 2019
বছর খানেক আগে থেকেই আমার আর বন্ধু মানিকের প্ল্যান কাশ্মির লাদাক সিমলা মানালী ট্যুরের! নানান সময়ে নানান প্ল্যান করেও ব্যাটে বলে হল না। ফাইনালী ব্যাটে বলে হলেও নো বলে মাইক রান আউট হয়ে ট্যুর থেকে বার হয়ে যায় আর আমি নো বল থেকে পাওয়া এক্সট্রা বলে সিক্স মেরে ট্যুর শুরু করি অন্য তিন ট্যুরমেটকে নিয়ে। শুরুতে আমাদের প্ল্যান ছিলো কলকাতা, কাশ্মির, মানালী আর সিমলা, বেশ লম্বা ট্যুর প্ল্যান! প্রায় ১৪ দিনের। কিন্তু অফিসিয়াল কিছু ঝামেলার কারনে আমার পক্ষে এতোদিনের পসিবল না দেখে আমি তা ৯ দিনে পরিনত করি মানে এপ্রিল ৯ – ১৭। এর মাঝে এপ্রিল ৯ চিটাগাং থেকে কলকাতায় যাওয়া আর ১৭ তারিখ কলকাতা থেকে চিটাগাং ব্যাক করা। ব্যাসিক্যালি মেইন ট্যুর ১০ – ১৬ আমার জন্য। অনেকে জানতে চেয়েছেন কাশ্মির ট্যুরের ব্যাপারে, আশা করি এই লিখা থেকে হয়তো কিছু মানুষ উপকৃত হবে। ট্যুরের টিকেট অনেক আগে করাতে আমরা অনেক কম দামে টিকেট পেয়েছিলাম, কলকাতা – শ্রীনগর- কলকাতা বাংলা টাকায় খরচ পড়েছিলো প্রায় ১৬ হাজার টাকা যা খুবই সস্তা আর এমন সস্তাতে টিকেট করতে পারার অন্যতম ক্রেডিট আমাদের ট্যুরমেন্ট লিমনের। আমি চিটাগাং থেকে রিজেন্টে চিটাগাং কলকাতা আপ ডাউনের টিকেট করেছিলাম, দুইটা মিলে মোট প্রায় ১২ হাজার পড়েছিলো মিনিমাম রেট পাই নাই লেট করে টিকেট করার কারনে। তবে কলকাতা – চন্ডিগর – শ্রীনগর – চন্ডিগর- কলকাতার টিকেট আগে করার কারনে অনেক সস্তা পেয়েছিলাম। আমি ৯ তারিখে দুপুরেই কলকাতা এয়ারপোর্টে পৌছে গিয়েছিলাম আর এদিকে আমার বাকি ট্যুরমেটরা রাতের ফ্লাইটে ঢাকা থেকে আসবে কলকাতা, আর আমাদের শ্রীনগরের ফ্লাইট পরের দিন ভোর ৪ঃ২৫ হওয়াতে আমি কলকাতা এয়ারপোর্টের ভেতরেই রেস্ট হাউজ টাইপ ওখানে ডরমিটরিতে একটা বেট রেন্ট নিয়েছিলাম। ভাড়া পড়েছিলো ৭০০ রুপি। বেশ উপকারী একটা ব্যাপার, সিংগেল রুম, ডাবল রুমের ব্যাবস্থাও আছে। সিংগেল রুমঃ ১০০০ রুপি, ডাবল রুমঃ ১৫০০ রুপি। কলকাতা থেকে শ্রীনগরের ফ্লাইট ছিলো ১০ তারিখ (৯ তারিখে রাত ১২ টার পরে যে ভোর -_- ) ভোর ৪ঃ৩৫ মিনিটে ইন্ডিগো এয়ারে। চন্ডীগর ভায়া হলে শ্রীনগরে গিয়েছিলো, চন্ডিগরে প্রায় ৩০ মিনিটের একটা ব্রেক ছিলো। শ্রীনগরে পৌছালাম সকাল ৯ টার দিকে। আমাদের একজন গাইড কাম ড্রাইভার আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো ওয়াসিম নামের, প্রচন্ড স্মার্ট একজন কাশ্মিরী। বেশ কোয়ালিফাইড স্মাইলিং ফেসের একজন মানুষ। উনি ঠিক ঠাকমত এয়ারপোর্টে উপস্থিত ছিলো, আমাদের রিসিভ করেই রওনা দিলো শহরের দিকে। আমাদের প্ল্যান মতে প্রথম দিন ছিলো ডাললেকের বোট হাউজে রাত কাটানো। কিন্তু আমরা প্ল্যান চেঞ্জ করে চলে গেলাম গুলমার্গে। যাওয়ার পথে হাইওয়ের পাশেই একটা ধাবাতে ব্রেকফাস্ট করেছিলাম পার হেড ১২০ রুপির মত পরেছিলো। গুলমার্গ বরফের চাদরে গেরা একটি গ্রাম। যদিও ওদের এখন সামার চলছে কিন্তু অনেকাংশই বরফে ঢাকা। গুলমার্গে একটা হোটেলে ছিলাম এক রাত, ভাড়া ছিলো ৪০০০ রুপি ব্রেকফাস্ট আর ডিনার সহ। ওয়াটার হিটার, রুম হিটার, বেড হিটার সবই ছিলো। হোটেলের নাম HILL VIEW. যদিও আমরা গুলমার্গে ছিলাম তবে আমি সাজেস্ট করবো গুলমার্গে না থেকে শ্রীনগরে ব্যাক করে হোটেলেই থাকা উচিত এতে সময় আর হোটেল খরচ দুইটাই বাচবে, কারন অপেক্ষাকৃত হোটেল খরচ বেশি গুলমার্গে। বিকেলের দিকে আমরা গিয়েছিলাম গন্ডালা মানে ক্যাবেল কারে করে গুলমার্কের মেইন পয়েন্টে যেখানে রয়েছে বরফের নানান ধরনের এক্টিভিটি, তবে বলে রাখা ভালো গুলমার্গে আসার আগেই ভাড়া করে নিয়েছিলাম বরফে নিজেকে বাচানোর জন্য জ্যাকেট, জুতো, গ্লাভস, মোজা। জ্যাকেট ভাড়াঃ ১০০ রুপি জুতোঃ ১০০ রুপি হাত মুজাঃ ২৫ রুপি দিয়ে কিনেছিলাম উলের পা মোজাঃ ১০০ রুপি দিয়ে কিনেছিলাম। গন্ডালা মানে ক্যাবেল কারে করে দুইটা ফেজে যাওয়া যায়, আমরা গিয়েছিলাম ফাস্ট ফেজে, যা ভুমি থেকে ১৪ হাজার ফিট উপরে আর সেকেন্ড ফেজ মনে হয় ২১ হাজার। ফাস্ট ফেজে যেতে খরচ ৭৪০ রুপি জন প্রতি। ক্যাবেল কার রাইডিং তেমন এক্সাইটেড না হলেও জায়গাটাতে গিয়ে ভালো লেগেছিলো, অনেকে স্কেটিং করছিলো, অনেকে আরো কি কি যেন করছিলো -_- সন্ধ্যা ৬ টার আগেই ওখান থেকে ব্যাক করতে হয়। ব্যাক করেই আমরা হোটেল রুমে চলে গিয়েছিলাম কারন রাতের বেলায় কিছুই করার নাই ওখানে! নো নাইট লাইফ -_- এর পরের দিন সকালে আমরা গুলমার্গ থেকে চলে গেলাম পেহেলগামের। পাহাড়ের পাশ ঘিরে ছোট একটি গ্রাম পেহেলগ্রাম, বেশ কষ্টেই তাদের দিন কাটে, পর্যটন ছাড়া তাদের কোন ইনকাম সোর্স নাই, গ্রামের মানুষদের অলমোস্ট প্রতিটি ঘরেই ঘোড়া পালে। টুকটাক ক্ষেতখামারী করে। আমি গ্রামে অনেকক্ষন হেটেছি, তাদের কষ্টের জীবন অনুভব করেছি। পেহেলগ্রামে আমরা দুই রাত ছিলাম, হোটেলের নাম ছিলো Hotel MUSKAN. পাহাড়ের উপরে অবস্থাতিত সাধারন মানের হোটেল। ভাড়া ছিলো প্রতিদিন ১৩০০ রুপি। হোটেলে কোন ব্রেকফাস্ট ছিলো না তবে অর্ডার করলে ওরা ম্যানেজ করে দেবে এমন। আমরা বাজারেই ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ ডিনার করেছিলাম যেহেতু সাথে গাড়ি ছিলো সবসময়। প্রথম দিনে আমরা গ্রামের আশে পাশেই ছিলাম, বাইরের কোথাও যাই নাই। সেকেন্ড ডে তে গিয়েছিলাম ঘোড়াতে করে Baisaran, যাওয়ার পথে পড়েছিলো Kasmir Valley and Dabyan. ব্যাসিকালি Baisaran বা মিনিসুইজারল্যান্ডই মূল আকর্ষন। বাকি দুটো জায়গা যাওয়ার পথে পড়ে, তবে ঘোড়া করে জার্নি আসলেই অনেক রিক্সি, কিন্তু তাও প্রচুর মানুষ যাচ্ছে, শুরুতে ভয় পাচ্ছে, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। এই ঘোড়া রাইডের খরচ পাতির ব্যাপার স্যাপার খুবই কনফিউজিং! ইনফ্যাক্ট কাশ্মিরের টুরিজমের পুরো ব্যাপারই কনফিউসিং! রেট এতো বেশি আপ ডাউন করে। প্রথমে আমাদের কাছে চাওয়া হল ২৭০০ রুপি পড়ে তা মুলা মুলি করে করে ফাইনালি ৮০০ রুপিতে দফারফা হয়েছে। ঘোড়া জার্নিটা যেমন রিমার্কেবেল ঠিক তেমন করে মিনিসুইজারল্যান্ডটাও অসাধারন যেমন দেখতে তেমন করে ছবি তুলতে। পেহেলগ্রামে দুইদিন থেকে আমরা রওনা দিলাম শ্রীনগরের দিকে, উদ্দ্যেশ্য ডাললেকের বোটে রাতে থাকা। পেহেলগ্রাম থেকে জার্নি টাইম ২ ঘন্টা হলেও আমাদের সেই দিন প্রায় ৫ ঘন্টা লেগেছিলো রোডে কাজের কারনে, মাঝে ব্রেকের কারনে আর রাস্তায় কাজের কারনে, শ্রীনগরে আমরা ডাল লেকের ঘাট ১৪ এর সামনে অনেক পুরানা হোটেলে Hotel Neheru তে ছিলাম, পুরাই অফ পিক সিজন, তাই রুম পেয়েছিলাম ১৭০০ রুপিতে ব্রেকফাস্ট ছাড়া। বেশ পুরানা হোটেল হলেও পুরানা ধাচের ভালো হোটেল ছিলো। যা বলছিলাম আমাদের টার্গেট ছিলো বোটে থাকা কিন্তু ৩-৪ টা বোট ভিজিট করে স্যাটিসফেক্টরী না পাওয়ার কারনে আমরা আর স্টে করি নাই, তবে অভিজ্ঞতার জন্য থাকা উচিত ছিলো। সেই দিন বিকেলের দিকে আমরা সিকারা রাইডে গিয়েছিলাম মানে নৌকা ভ্রমন। প্রথমে আমাদের কাছে চেয়েছিলো ১০০০ টাকা এর মত পরে তা ৩০০ রুপিতেই এগ্রি করে আমাদের ১ ঘন্টার মত ঘুরিয়েছিলো, অনেক দিন পরে ম্যানুয়াল ভিন্নটাইপের নৌকা ভ্রমন বেশ ভালো লেগেছিলো। এর পরের দিন বিকেলেও আমরা ২ ঘন্টা ঘুরেছিলাম ৬০০ রুপিতে। শ্রীনগরে সেকেন্ড ডে তে আমরা সকাল সকাল গিয়েছিলাম টিউলিপ গার্ডেনে, ডাল লেক থেকে খুব একটা দূরে না, বেশ কাছেই! এক অনন্য সৃষ্টি আর সোন্দর্য্য! কি যে ভালো লেগেছিলো এতো সুন্দর করে বানানো বাগান যার সময় ১ মাসের থেকেও কম! আমরা লাকি ছিলাম যে বেস্ট টাইমটাতেই আমরা টিউলিপ গার্ডেনে গিয়েছিলাম। এন্ট্রি ফি ৫৯ রুপি করে। টিউলিপে কেমন করে ৩ ঘন্টা চলে গেলো বুঝতেই পারি নাই, তার পর গেলাম আমরা মোগলদের বানানো রানী মহলে বেশ উচু পাহাড়া বানানো রানী মহল, সময় স্বল্পতা আর টায়ার্ডনেসের কারনে Mughal Empire দেখা হয় নাই। খানা পিনার ব্যাপার যখন যা পেয়েছি তাই খেয়েছি, ভালো খারাপ মিক্স রিয়েকশন ছিলো আমাদের। কাশ্মিরে এপ্রিল ১০- ১৫ তারিখ পর্যন্ত আমাদের ৪ জনের পার হেড খরচ পড়েছিলো প্রায় ১৬৫০০ টাকা। আমরা একটু বেহিসাবি ছিলাম তা না হলে সহজেই আরো ২০০০-৩০০০ টাকা বাচানো যেতো। আর এই ১৬৫০০ তে সব এক্টিভিটির খরচ ও ছিলো। কাশ্মির থেকে আমরা গিয়েছিলাম চন্ডিগরে, এক রাত থেকে আমি কলকাতা হয়ে বাংলাদেশ ব্যাক করেছি আর আমার বাকি ট্যুরমেটরা সিমলা মানালীতে বেড়াচ্ছে -_- জানি উপরের লিখাটা খুব একটা ঘোছানো না, তাই কিছু কি পয়েন্ট নিচে উল্লেখ করছি। – আমরা কাশ্মিরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা জীপ টাইপ গাড়ি ভাড়া করেছি যা আমাদের গাইড হিসাবে যেমন সার্ভিস দিয়েছিলো ঠিক তেমন করে প্রতিপদে আমাদের গাড়ির সাপোর্ট দিয়েছিলো। কাশ্মিরের প্রতিদিনের জন্য আমরা ২২০০ রুপি করে দিয়েছিলাম। – কাশ্মিরে মোবাইল নেট ওয়ার্কে ভালোই সমস্যাতে পড়েছিলাম, সিম কেনা পুরোই অসম্ভব ব্যাপারে, একমাত্র পোস্টপেইড সিমই কাজ করে ওখানে তাও লোকাল কারো নামে রেজিঃ করা সিম। আমাকে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার একটা সিম ম্যানেজ করে দিয়েছিলো। – এক ডলার এর জন্য ৬৭-৭০ রুপি পেয়েছি। – খাওয়ার মান বেশ ভালো আর তুলনামুলক ভাবে সস্তা, আমরা অনেক স্ট্রিট ফুড ট্রাই করেছিলাম – কাশ্মিরের সাধারন মানুষ গুলো বেশ ভালো কিন্তু টুরিজমের সাথে জড়িতরা একটু ধান্দাবাজ টাইপের আর ইরিটেটিং। বার বার মানা করার পরেও পেছন ছাড়ে না। – পলিটিক্যাল আনরেস্টের কিছুই পাই নাই, আমাদের স্টের ভেতরে দুইদিন ইলেকশন পরে গিয়েছিলো তাই মোবাইলের নেট বন্ধ পেয়েছিলাম কিন্তু বাকি সব নরমাল ছিলো। ইলেশকনের দিন সাধারন পরিবহন বন্ধ থাকলেও ট্যুরিস্টদের গাড়ি এলাউড ছিলো। ৬ দিনের মাঝে মাত্র একবার আমাদের গাড়ি দাড় করানো হয়েছিলো তাও পাসপোর্ট দেখে সম্মানের সাথে সরি বলে ছেড়ে দিয়েছিলো। তবে রিসেন্ট যে টেরোরিস্ট এটাক হয়েছিলো তার কারনে কাশ্মিরের মোড়ে মোড়ে সেনা টহল অনেক বেশি আর একটিভ। তবে এটা ঠিক, কাশ্মির যাওয়া উচিত, বাচ্চাদের জন্য এক্কটু ডিফিকাল্ট লম্বা জার্নি গুলোর কারনে প্লাস ঠান্ডা টাইপ ব্যাপার স্যাপার আর এন্টারটেইনমেন্টের জিনিষ পাতিকম তাই বাচ্চারা খুব একটা এঞ্জয় করার কথা না।